ইউএসএআইডি বন্ধের ঘোষণা: বৈশ্বিক স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা

ইউএসএআইডি বন্ধের ঘোষণা: বৈশ্বিক স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা
ডেস্ক রিপোর্ট
যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি) বন্ধের ঘোষণায় বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা গভীর উদ্বেগ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, সংস্থাটির বৈদেশিক সহায়তা বন্ধ হলে টিকা, চিকিৎসা গবেষণা এবং সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম হুমকির মুখে পড়তে পারে।
ট্রাম্প প্রশাসনের ঘোষণা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ইউএসএআইডির বিশাল কর্মীসংখ্যা ছাঁটাই এবং প্রায় সব ধরনের বৈদেশিক সহায়তা কার্যক্রম স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার জানিয়েছে, ৯০ দিনের জন্য সব বৈদেশিক সহায়তার অর্থায়ন বন্ধ থাকবে এবং এই সময়ের মধ্যে পর্যালোচনা করা হবে যে এটি ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না।
ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরেই বৈদেশিক ব্যয়ের সমালোচনা করে আসছেন এবং তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির সঙ্গে একে মানানসই করার কথা বলেছেন। প্রশাসন বিশেষ করে ইউএসএআইডিকে লক্ষ্যবস্তু করেছে, সংস্থাটির ব্যয়কে ‘সম্পূর্ণ অযৌক্তিক’ এবং কিছু প্রকল্পকে ‘করদাতাদের অর্থের অপচয়’ বলে অভিহিত করেছে।
সংক্রামক রোগ বৃদ্ধির আশঙ্কা
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে সংক্রামক রোগের বিস্তার, টিকা প্রদান এবং চিকিৎসা গবেষণায় বিলম্ব ঘটতে পারে।
যুক্তরাজ্যের লিভারপুল স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ ড. টম উইংফিল্ড বলেন, “ইউএসএআইডি বন্ধের প্রভাব এতটা গভীর হবে যে তা কমিয়ে দেখার সুযোগ নেই। এটি অপুষ্টি, স্বাস্থ্যবিধি, টয়লেটব্যবস্থা এবং বিশুদ্ধ পানির প্রবাহ নিশ্চিতের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় হয়ে থাকে, যা সংক্রামক রোগের বিস্তার রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।”
প্রতিবছর এক কোটি মানুষ যক্ষ্মা (টিবি) রোগে আক্রান্ত হয় এবং ১৩ লাখ মানুষ মারা যায়। কিন্তু ৪০ শতাংশ রোগী কোনো চিকিৎসা পায় না। ফলে তারা রোগটি ছড়িয়ে দেওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, “যদি কোনো গবেষণা প্রকল্প বা ক্লিনিক বন্ধ হয়ে যায়, তবে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে এবং মানুষ সরাসরি মারা যাবে।”
এইচআইভি চিকিৎসায় বিপর্যয়ের আশঙ্কা
শুধু টিবি নয়, এইচআইভি চিকিৎসাসেবার ওপরও ইউএসএআইডি বন্ধের বড় প্রভাব পড়তে পারে।
অনেক এনজিও ইউএসএআইডির সহায়তায় অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল ওষুধ সরবরাহ করে, যা এইচআইভি সংক্রমণ রোধে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তহবিল বন্ধ হলে চিকিৎসাধীন রোগীদের ওষুধ সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হতে পারে, ফলে ভাইরাসের বিস্তার বাড়বে।
বিপর্যয়কর প্রভাব
যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকাভিত্তিক সংস্থা ‘ফ্রন্টলাইন এইডস’ জানিয়েছে, তাদের ৬০টি অংশীদারি সংস্থার মধ্যে ২০টির বেশি ইউএসএআইডি সহায়তা বন্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক জন প্লাস্টো বলেন, “এই তহবিল স্থগিত হওয়ায় অনেক সংস্থা তাদের কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে, কর্মীদের বরখাস্ত করতে হয়েছে। এটি ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
ভবিষ্যতে মহামারির ঝুঁকি
ইন্টারন্যাশনাল ল অ্যান্ড গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের অধ্যাপক রোজা ফ্রিডম্যান বলেন, ইউএসএআইডি বিশ্বব্যাপী মোট উন্নয়ন সহায়তার প্রায় ৪০ শতাংশ প্রদান করে, যা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ব্যয় হয়।
তিনি বলেন, “এই সহায়তা দীর্ঘদিনের জন্য বন্ধ থাকলে প্রতিষেধক সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিতে পারে। ফলে যেসব রোগ নিয়ন্ত্রণে ছিল, যেমন কলেরা ও ম্যালেরিয়া, সেগুলো নতুন করে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈশ্বিক পারস্পরিক নির্ভরশীলতার যুগে এই রোগগুলো দ্রুত ও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা গোটা বিশ্বের জন্য ভয়াবহ সংকট তৈরি করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তিতে আঘাত
সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিটার টেইলর বলেন, “এই তহবিল বন্ধের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি হওয়া। যেকোনো কিছু হঠাৎ বন্ধ করে দিলে মানুষের বিশ্বাস নষ্ট হয়। মানুষ বিভ্রান্ত ও ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউএসএআইডি বন্ধের সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র স্বাস্থ্যখাতে নয়, যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক ভাবমূর্তির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
শেষ কথা
বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বলছেন, ইউএসএআইডির মতো সংস্থার সহায়তা বন্ধ হলে সংক্রামক রোগের বিস্তার বৃদ্ধি পাবে, যা ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ মহামারির জন্ম দিতে পারে।