অতিরিক্ত মোবাইল স্ক্রলিং: বর্তমান প্রজন্মের ভয়াবহ আসক্তি ও স্বাস্থ্যঝুঁকি

অতিরিক্ত মোবাইল স্ক্রলিং: বর্তমান প্রজন্মের ভয়াবহ আসক্তি ও স্বাস্থ্যঝুঁকি
বর্তমান যুগ ডিজিটাল দুনিয়ার যুগ। মোবাইল ফোন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। কাজ থেকে শুরু করে বিনোদন, শিক্ষা, যোগাযোগ—সবকিছুই এখন মোবাইলের মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। তবে, অনেকেই এটি প্রয়োজনের বাইরে অতিরিক্ত ব্যবহার করছেন, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় অপ্রয়োজনীয় স্ক্রলিং ও ভিডিও দেখার প্রবণতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
ঘুমাতে যাওয়ার আগে, খাওয়ার সময়, এমনকি ঘুরতে গেলেও মোবাইল স্ক্রলিংয়ের অভ্যাস অনেকের মধ্যে দেখা যায়। এটি শুধু সময়ের অপচয়ই নয়, গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
অতিরিক্ত মোবাইল স্ক্রলিংয়ের ক্ষতিকর দিক
১. হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতিদিন ৩-৪ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় মোবাইল স্ক্রলিং করেন, তাদের মধ্যে হৃদরোগ ও হাইপারটেনশনের ঝুঁকি বেড়ে যায়। দীর্ঘক্ষণ একই ভঙ্গিতে বসে মোবাইল ব্যবহারের ফলে রক্তচাপ বাড়তে পারে, যা ভবিষ্যতে হৃদরোগের কারণ হতে পারে।
২. ঘুমের সমস্যা (Insomnia)
রাতে ঘুমানোর আগে মোবাইল স্ক্রলিং অনেকের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু মোবাইলের স্ক্রিন থেকে নির্গত ব্লু লাইট মস্তিষ্কের মেলাটোনিন হরমোনের উৎপাদন কমিয়ে দেয়, যা ঘুমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে ঘুম কমে যায়, ঘুম ভেঙে গেলে পুনরায় ঘুমাতে সমস্যা হয় এবং পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে দিনের বেলায় অবসাদ ও কাজের প্রতি মনোযোগ কমে যেতে পারে।
৩. মানসিক চাপ ও উদ্বেগ (Anxiety & Stress)
অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের কারণে অনেকেই অন্যের জীবন দেখে হীনমন্যতায় ভোগেন, যা মানসিক চাপ ও উদ্বেগ সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারের ফলে স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা ডিপ্রেশন ও উদ্বেগের অন্যতম কারণ।
৪. স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগের ঘাটতি
অতিরিক্ত মোবাইল স্ক্রলিং স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। একটানা মোবাইল ব্যবহার করলে মস্তিষ্কের তথ্য সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। ফলে পড়াশোনা বা অফিসের কাজে মনোযোগ কমে যায় এবং ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে।
৫. চোখের সমস্যা (Eye Strain & Headache)
দীর্ঘক্ষণ মোবাইল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে চোখের শুষ্কতা, লালচে ভাব, চোখের ব্যথা ও মাথাব্যথা হতে পারে। এটি একসময় কমদৃষ্টির (Blurry Vision) কারণ হতে পারে।
৬. সামাজিক বিচ্ছিন্নতা (Social Isolation)
অনেকেই বাস্তব জীবনের মানুষের সঙ্গে মিশতে না পেরে ভার্চুয়াল জগতে বেশি সময় ব্যয় করেন। এতে করে পরিবারের সদস্য, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সময় কাটানোর প্রবণতা কমে যায়, যা মানসিকভাবে একাকীত্বের অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে।
ডিজিটাল আসক্তি কমানোর কার্যকরী উপায়
১. নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করুন
প্রতিদিন কতক্ষণ মোবাইল ব্যবহার করবেন তা নির্ধারণ করুন। মোবাইলের ‘Screen Time’ ফিচার ব্যবহার করে দৈনিক ব্যবহারের পরিমাণ কমানোর চেষ্টা করুন।
২. বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন
বিনোদনের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রলিংয়ের বদলে বই পড়ার অভ্যাস করুন। এটি মানসিক প্রশান্তি আনবে এবং একাগ্রতা বৃদ্ধি করবে।
৩. শরীরচর্চা ও মেডিটেশন করুন
নিয়মিত শরীরচর্চা ও মেডিটেশন মস্তিষ্কের সচলতা বাড়ায়, মানসিক চাপ কমায় এবং সুস্থ থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৪. স্ক্রিন টাইম কমিয়ে বাস্তব জীবনে মনোযোগ দিন
বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো, খেলাধুলা করা, গান শেখা, ছবি আঁকা বা অন্য কোনো সৃজনশীল কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। এতে করে মোবাইলের প্রতি নির্ভরতা কমবে।
৫. ঘুমানোর আগে মোবাইল ব্যবহার এড়িয়ে চলুন
রাতে ঘুমানোর অন্তত ৩০-৪৫ মিনিট আগে মোবাইল স্ক্রলিং বন্ধ করুন। এতে নিঃশব্দ ঘুম নিশ্চিত হবে এবং সকালে আরও চাঙ্গা অনুভব করবেন।
৬. ডার্ক মোড ও আই প্রোটেকশন ব্যবহার করুন
স্ক্রিনের আলো চোখের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই ‘ডার্ক মোড’ ও ‘আই প্রোটেকশন মোড’ চালু রাখুন এবং অতিরিক্ত স্ক্রলিং থেকে বিরত থাকুন।
শেষ কথা
অতিরিক্ত মোবাইল স্ক্রলিং শুধু সময়ের অপচয়ই নয়, এটি আমাদের স্বাস্থ্য ও মানসিক সুস্থতার জন্যও হুমকিস্বরূপ। তাই সময় থাকতে সচেতন হওয়া জরুরি। সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে সক্রিয় থাকুন, সৃজনশীল কাজে মনোযোগ দিন এবং ডিজিটাল আসক্তি থেকে মুক্ত থাকুন।
পরিমিত মোবাইল ব্যবহারে সুস্থ জীবন যাপন করুন!
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা