ব্যবসা বাণিজ্য

ভ্যাট আদায়ে ঘাটতি: ব্যবসায়ী-কর্মকর্তার যোগসাজশ ও দুর্নীতির অভিযোগ

ভ্যাট আদায়ে ঘাটতি: ব্যবসায়ী-কর্মকর্তার যোগসাজশ ও দুর্নীতির অভিযোগ

মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) রাজস্ব আয়ের সবচেয়ে বড় খাত হলেও ব্যবসায়ী ও কর কর্মকর্তাদের মধ্যে যোগসাজশ, ঘুষ ও দুর্নীতির কারণে ভ্যাট আদায়ে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। এফবিসিসিআইয়ের তথ্য অনুযায়ী, সাড়ে তিন কোটি ব্যবসায়ী তালিকাভুক্ত থাকলেও এনবিআরের খাতায় ভ্যাটের জন্য নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান মাত্র সাড়ে পাঁচ লাখ। এর মধ্যে সবাই নিয়মিত রিটার্নও জমা দেয় না। ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৮ হাজার কোটি টাকা।

২০২১ সালের মে মাসে এনবিআরের ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও সাভারের ২৫টি মার্কেটে অভিযান চালিয়ে ১৫ হাজার ৪৮২টি প্রতিষ্ঠানের ওপর জরিপ করে। তাতে দেখা যায়, ১২ হাজার ৮৭১টি প্রতিষ্ঠান (৮৮ শতাংশ) ভ্যাট দেয় না। এছাড়া বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এক কোটি ১৮ লাখ। তবে এনবিআর এসব প্রতিষ্ঠানের বড় অংশকে ভ্যাটের আওতায় আনতে পারেনি।

ডিজিটাইজেশন ও অটোমেশনের অভাব
ভ্যাট আদায়ে ডিজিটাইজেশন ও অটোমেশনের অভাবকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এনবিআর অটোমেশন পদ্ধতি চালুর কথা থাকলেও তা বাস্তবায়ন না করে ম্যানুয়াল পদ্ধতি বন্ধ করে দিয়েছে। এতে ভ্যাট ফাঁকির সুযোগ বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৬ হাজার কোটি টাকা, কিন্তু আদায় হয়েছে মাত্র ৫৫ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা।

ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ
ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন, এনবিআর নতুন ভ্যাটদাতা প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করার পরিবর্তে ভ্যাটের হার বাড়িয়ে সহজে রাজস্ব আদায়ের চেষ্টা করছে। সম্প্রতি শতাধিক পণ্যের ওপর বাড়তি ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে, যা ব্যবসায়ীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। চাপের মুখে সরকার ছয়টি পণ্যের ভ্যাট কমালেও বেশির ভাগ পণ্যের ভ্যাট হার অপরিবর্তিত রয়েছে।

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, “এনবিআর সব সময় শর্টকাট পদ্ধতিতে চলার চেষ্টা করে। অটোমেশন ও ডিজিটাইজেশন ছাড়া ভ্যাট আদায় বাড়ানো সম্ভব নয়।” তিনি আরও যোগ করেন, “দেশে সাড়ে চার থেকে পাঁচ কোটি ব্যবসায়ী আছে। তাদের মধ্যে যারা ভ্যাট দেয় না, তাদের খুঁজে বের করতে হবে।”

বকেয়া ভ্যাট ও মামলা
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মামলায় ৩১ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট আটকে আছে। এর মধ্যে হাইকোর্টে ২৮ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা এবং আপিল বিভাগে তিন হাজার ২৭৪ কোটি টাকা আটকে রয়েছে। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলার কাছেই ২০ হাজার কোটি টাকা বকেয়া ভ্যাট রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, “ভ্যাট আদায় প্রক্রিয়ার ফাঁকি রোধ করতে হবে। আওতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ফাঁকি প্রক্রিয়াটা যুক্ত আছে। প্রত্যক্ষ করের ওপর বেশি জোর দিতে হবে।”

ব্যবসায়ীদের দাবি
ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, ভ্যাটের হার না বাড়িয়ে ভ্যাটের আওতা বাড়ানো হোক। তারা মনে করছেন, অটোমেশন ও ডিজিটাইজেশন করে বেশি প্রতিষ্ঠান থেকে ভ্যাট আদায়ের পথে যাওয়া উচিত। না হলে ব্যবসার মন্দা সময়ে যারা নিয়মিত ভ্যাট দেয়, তাদের ওপর চাপ বাড়বে এবং সরকারও কাঙ্ক্ষিত ভ্যাট পাবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button