সারাদেশ

গুমের ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ: তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন

গুমের ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ: তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন

গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন (দ্য কমিশন অব ইনকোয়ারি অন এনফোর্সড ডিস-অ্যাপিয়ারেন্স) তাদের একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, যেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম গুমের ঘটনায় নির্দেশদাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে আরও বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নামও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এই প্রতিবেদন গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মধ্যে নতুন করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

গতকাল শনিবার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদনটি জমা দেন কমিশনের সদস্যরা। প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল “আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ”, যেখানে কমিশনের তদন্তকৃত বিষয়গুলো বিশদভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

এ পর্যন্ত কমিশনে মোট ১,৬৭৬টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৭৫৮টি অভিযোগ যাচাই করা হয়েছে এবং ১৭২টি অভিযোগে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট র‌্যাবের ভূমিকা উল্লেখ করা হয়েছে। গুমের ঘটনায় অভিযুক্তদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নামগুলো হলো:

  • সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
  • তার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক।
  • সাবেক র‌্যাব কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান।
  • পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) প্রাক্তন প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম।
  • ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।

তদন্ত কমিশন জানিয়েছে, গুমের শিকার ব্যক্তিদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়েছিল, যা এখনও তাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে রেখেছে। তাদের অনেকে এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেননি। কমিশনের মতে, গুমের ঘটনাগুলো এমনভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল যাতে তা শনাক্ত করা কঠিন হয়। এতে বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে ভিকটিম বিনিময়ের মতো অপকৌশল ব্যবহার করা হয়েছিল।

কমিশনের প্রধান বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী জানান, ভুক্তভোগীদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যাদের রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না। আবার অনেকেই সরকারের সমালোচনা করার কারণে গুমের শিকার হয়েছেন।

গুমের ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি কমিশন কয়েকটি সুপারিশ করেছে:

  1. র‌্যাব বিলুপ্ত করা।
  2. গুমের শিকার ব্যক্তিদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা।
  3. আন্তর্জাতিক আদালতে এই ঘটনাগুলোর বিচার নিশ্চিত করা।

কমিশন জানিয়েছে, চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে আরও এক বছর সময় লাগবে। আগামী মার্চ মাসে একটি নতুন অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গুমের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “যারা গুম ও খুনের সঙ্গে জড়িত, তারা যতই শক্তিশালী হোক, কোনোভাবেই ছাড় পাবে না। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতের সহযোগিতা নেওয়া হবে।”

তিনি আরও বলেন, গুমের ঘটনায় যারা ভুক্তভোগী, তাদের অভিযোগ নিতে সরকার সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। ভুক্তভোগীরা যাতে ভয় ছাড়া তাদের বক্তব্য তুলে ধরতে পারে, সেজন্য কমিশনের কার্যক্রম আরও প্রসারিত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার সঙ্গে জড়িত ২২ জন কর্মকর্তার পাসপোর্ট ইতোমধ্যে বাতিল করা হয়েছে এবং তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এসব কর্মকর্তাদের বেশিরভাগই র‌্যাব, ডিজিএফআই এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন।

এ প্রতিবেদন দেশের রাজনৈতিক মহলে এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে নতুন করে আলোচনা তৈরি করেছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে এবং সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে।

কমিশনের এই প্রতিবেদন গুমের ঘটনাগুলো নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা অভিযোগ ও শঙ্কার বিষয়গুলো আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। এখন দেশবাসী অপেক্ষায় রয়েছে এই তদন্তের চূড়ান্ত ফলাফলের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button